
হজ্বে এসে যার সাথেই দেখা হয়- সবাই প্রায় একইরকম প্রশ্ন করে থাকেন আপনি
কোত্থেকে এসেছেন অথবা আপনার দেশ কোথায়? খুব সরল একটি প্রশ্ন।
মিনায় অবস্থানকালে এমনই এক প্রশ্ন করেছিলাম এক বয়োবৃদ্ধ হাজী সাহেবকে, তিনি
চেয়ার বসা ছিলেন; প্রশ্ন শেষ হওয়ার খানিক পর দেখা গেল আমরা দুজনেই কাঁদছি!
মানুষটি সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। বিশ থেকে চল্লিশ
বছর বয়সী পাঁচ সন্তানের বাবা তিনি। সন্তানেরা সবাই ইসলামিক স্টাডিজে গ্রাজ্যুয়েট
সম্পন্ন করেছেন। বিয়ে করে সংসার জীবনে থিতুও হয়েছেন সকলে।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আলেপ্পোতে মানুষ কিভাবে বসবাস করে? তাদের জীবনধারা
ঠিক কেমন?
প্রশ্ন শেষ হতেই দেখা গেল তার চোখে অশ্রু চিকচিক করছে! আবেগাক্রান্ত মনে নীরব
হয়ে বসে থাকলেন খানিক সময়। তারপরে আমার প্রশ্নের জবাবে বলতে শুরু করলেন এক
বেদনাদায়ক উপাখ্যান।
একদিন, এক ভয়ানক বিমান হামলায় তার পরিবারের সবাই প্রাণ হারিয়েছে। তার বাড়ি,
প্রিয়তমা স্ত্রী, ছেলে-সন্তান, নাতি-নাতনী, মোট সতেরোটি তাজা প্রাণ সেই অসুরিক
বিমান হামলায় প্রাণ হারায়।
যে মসজিদে তিনি ইমামতি করতেন সেটিও একইরকম বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়।
মানুষটি অঝোরে কাঁদছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না
আমি। চোখে বাঁধহীন অশ্রু নিয়ে তিনি বলেছেন, এই দুর্ঘটনা তাকে পবিত্র কুরআনের
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন আয়াতের মর্ম ভালভাবে অনুধাবন
করিয়েছে।
তারপর তিনি আমাকে দেখান বুলেটের আঘাতে কিভাবে তার পুরো শরীর জর্জরিত হয়ে
আছে। একটি বুলেট তার বাহুকে চিড়ে দিয়ে তর্জনী পর্যন্ত পৌঁছেছে, যার কারণে তিনি
তার আঙ্গুল নাড়াতে পারেন না।
তবে আমাকে পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে তিনি এক অবিশ্বাস্য তথ্য জানালেন; তিনি
বলেন, আল্লাহ্ আমার সবকিছু নিয়ে গেছেন। আমার পরিবার, স্ত্রী-সন্তান, ঘর-
সম্পদ, সবকিছু। এবং আমাকে একাকী করে দিয়েছেন। তবু আমি কোনো অভিযোগ করি
না। আমার শুধু একটিই চাওয়া, তিনি যেন আমাকে পুনরায় আমার তর্জনী নাড়ানোর
শক্তি দেন; যাতে আমি শাহাদাহ পাঠ করার সময় সেটি উঁচু করতে পারি।
তার এ কথা শুনে আমার মুখে কথা বেরোয় না। আল্লাহর কসম, ইনি আল্লাহর মকবুল
বান্দা। তিনি আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা চান নি। কোনো সাহায্যও চান নি। এমনকি
তার গল্পটি মানুষকে জানাতে কোনোরকম আগ্রহ দেখান নি। বরং তিনি তার হজ্ব
সম্পন্ন করার কথা বলে অনেকটা পালিয়ে বেঁচেছেন আমার থেকে, যাতে আমি তাকে
কোনো ছবি উঠানোর অনুরোধ করতে না পারি। তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করব
ভাবছিলাম, সেসময় জানলাম, মক্কায় উঠার জন্য কোনো হোটেলেরও ব্যবস্থা নেই
তার!
এ মানুষগুলোকে শুধু ইতিহাসের পাতাতেই খুঁজে পাব আমরা। গল্পের শব্দ-স্রোতে তাদের
বেদনা আমাদেরকে প্লাবিত করবে। অথচ তাদের জন্য করনীয় কিছু করতে পারব না
আমরা। খুবই দুঃখজনক।
আল্লাহ্ তাকে ও তার পরিবারকে জান্নাত নসিব করুণ। আমিন।